ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট ও গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেও, তার অসম্পূর্ণ চক্রান্ত বাস্তবায়নে রেখে গেছেন অসংখ্য দোসর ও তোষামোদকারী। যারা প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘাঁপটি মেরে বসে আছেন। কেউ-কেউ খোলনলচে বদলে বিএনপি-জামাত ঘরানায় নিজেদেরকে সাজিয়ে তোলার মতলব আঁটছেন। তাদেরই একজন কবি ও গীতিকার সুজন হাজং। তিনি নেত্রকোনার বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর, শেখ হাসিনার একান্ত আস্থাভাজন এবং শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগের চরম তোষামোদকারী হিসেবে শিল্প-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত সুজন হাজং স্বপদে বহাল থেকে নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের তোষামোদ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক জগতের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে নিয়ে লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। লিখেছেন শত শত কবিতা ও গান। এমনকি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর প্রস্তুতিও নিয়েছেন। ৫ আগস্টে পট-পরিবর্তনের পর সুজন হাজং অত্যন্ত চতুরতার সাথে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বিএনপি ঘরানার নেতা-কর্মীদের সাথে উঠা-বসা করে জিয়ার সৈনিক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বিগত সময়ে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং আওয়ামী লীগের চরম তোষামোদ করে ফলও পেয়েছেন তিনি। তার তোষামদীর পুরস্কার স্বরূপ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজনৈতিক কোটায় শেখ হাসিনা তাকে দুই বছরের জন্য বিরিশিরি কালচারাল অ্যাকাডেমিতে পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। পরবর্তীতে মেয়াদ শেষ হলে ২০২৩ সালে একই পদে আরও দুই বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ দেয়। যার মেয়াদ এখনও চলমান এবং বর্তমানে সুজন হাজং স্বপদেই বহাল আছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী দোসর সুজন হাজং একাডেমিতে ঘাঁপটি মেরে বসে আছেন। অনুসন্ধানে তার একাধিক গাড়ি, রাজধানীর ওয়ারীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ঢাকা,গাজীপুর ও নেত্রকোনার বিভিন্নস্থানে জমি-প্লটসহ নামে বেনামে প্রচুর সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও শেখ পরিবারের প্রতি সুজন হাজং-এর যতো তোষামোদী:—
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রতি সুজন হাজং-এর তোষামোদি অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। শেখ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে নিয়েই তিনি লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। লিখেছেন প্রচুর গান ও কবিতা। যে গান ও কবিতাগুলো আবার বাংলাদেশ ও ভারতের নামি-দামি শিল্পীদের দিয়ে গাইয়েছেন এবং আবৃত্তি করিয়েছেন নিজের লগ্নিকৃত অর্থে। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার কন্ঠে “ভোরের সূর্য” ও শুভমিতার কণ্ঠে “আবার এসো পিতা”, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন উপলক্ষ্যে অবন্তি সিঁথির কণ্ঠে “আমাদের বঙ্গমাতা”, শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে বেলাল খান ও আতিয়া আনিসার কণ্ঠে “আলোকবর্তিকা” এবং কিশোর দাশ, লিজা, পুলক ও পুতুলের কণ্ঠে “জনতার মঞ্চে”, শেখ রাসেলের জন্মদিনে “অবন্তি সিঁথি”র কণ্ঠে “ভোরের আকাশ”, জাতীয় শোক দিবস ১৫ ই আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে “সুবীর নন্দী”র কণ্ঠে “ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর”, ফাহমিদা নবীর কণ্ঠে “পিতার রক্তে” ও নিশিতা বড়ুয়ার কণ্ঠে “রক্তমাখা সিঁড়ি” ইত্যাদি গানের রচয়িতা তিনি। প্রতিটি গান ও ভিডিওর অর্থলগ্নিও তিনি নিজেই করেছেন। শুধু শেখ পরিবার নিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি সুজন হাজং। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন ও সাফল্য নিয়ে সাব্বির ও লিজার কণ্ঠে “উন্নয়ন” শিরোনামের গানটিও তারই লেখা।
এসব তোষামোদী করে আওয়ামী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ভাগিয়ে নিয়েছেন নানাবিধ অ্যাওয়ার্ড। পেয়েছেন ‘শেখ রাসেল স্মৃতি পাঠাগার পদক’ (২০১৭), ‘ডায়মন্ড হারবার প্রেসক্লাব সম্মাননা’ (কলকাতা ২০১৮), ‘সলিল চৌধুরী স্মৃতি পদক ২০১৯’ (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)-সহ বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
তার তোষামোদীতে সন্তুষ্ট হয়ে শেখ হাসিনা তাকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেত্রকোনার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিরিশিরি কালচারাল একাডেমীর পরিচালক পদে রাজনৈতিক কোটায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন এবং প্রথম দফার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে আরও দুই বছরের জন্য একই পদে বহাল রাখেন। সরকারি এমন লোভনীয় পদ পেয়েও সুজন হাজং এর তৃপ্তি মেটেনি। তাই তো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হওয়ার বাসনায় ৭ জানুয়ারি ২০২৪-এর ডামি নির্বাচনে অংশ নিতে ২১ নভেম্বর ২০২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নেত্রকোনা-১ (দুর্গাপুর- কলমাকান্দা) আসনে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র কেনেন। এর আগেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে প্রার্থী হতে দলীয় মনোনয়ন কেনেন তিনি।
সুজন হাজং ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা কালীন আওয়ামী তোষামোদি করতে গিয়ে আওয়ামী সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। তার সকল প্রতিভা যেন আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করেই। তিনি ছিলেন একাধারে আওয়ামী লীগের কবি, গীতিকার, কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।
২০২৪-এর ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারণার জন্য গানও লিখেছেন সুজন হাজং। “যেতে হবে দূর বহুদূর, সারা বাংলায় একই সুর, জোরছে মারো টান, গাও নৌকার গান” এমন কথামালার গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন বেলাল খান। এছাড়া শেখ মুজিবুুর রহমানকে নিয়ে “বঙ্গবন্ধু: দ্য মর্নিং সান” নামে মিউজিক্যাল ডকুফিল্মের নির্মাতাও তিনি। নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে তার এসব তোষামোদি ও চাটুকারিতায় পূর্ণ গান ও ডকুফিল্ম নিয়মিত প্রচার করতেন । ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের নজর এড়াতে চ্যানেলটি বর্তমানে হাইড করে রেখেছেন তিনি। একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক সুজন হাজং- এর আওয়ামী প্রীতি ও তোষামোদীর মাধ্যমে দুর্নীতি করে অর্জিত অবৈধ অর্থ-সম্পদের বিস্তর তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে। পর্যায়ক্রমে পাঠকের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।
বিরিশিরি কালচারাল অ্যাকাডেমীর একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এই প্রতিবেদকদের কাছে সুজন হাজং-এর অ্যাকাডেমিতে এখনও বহাল থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা জানান— শুধু চাকরি থেকে বরখাস্তই নয়, তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখোমুখি করাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অ্যাকাডেমির পরিচালক পদে থেকে সীমাহীন দুর্নীতি করে গত চার বছরে তিনি হাতিয়েছেন বিভিন্ন প্রকল্পের কয়েক কোটি টাকা। তার দুর্নীতির বিচার করা এখন সময়ের দাবি। অথচ বিএনপি ঘরানার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সুকৌশলে ম্যানেজ করে, অন্তর্বর্তী সরকারের নজর এড়িয়ে বহাল তবিয়তে ঘাঁপটি মেরে বসে আছে শেখ হাসিনার পা চাটা দোসর সুজন হাজং। অবিলম্বে তাকে বিরিশিরি কালচারাল একাডেমীর পরিচালক পদ থেকে বরখাস্ত করে দুর্নীতির বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তারা। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থ-সম্পদের অভিযোগ সম্পর্কে সুজন হাজং-এর বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ভাই আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আপনি নিউজটা এখন করবেন না। আমি ঢাকার বাইরে আছি। এসে সাক্ষাতে আপনার সাথে কথা বলবো। তথ্যের বিষয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভাই সাক্ষাতে বলবো।