‘‘যদি আর জন্মে আবার পলাশীতে আসার সুযোগ হয়, তাহলে আবার আমি মীর জাফরকে বিশ্বাস করব।’’ এটি ‘নবাব সিরাউদ্দৌলা’ যাত্রাপালার বিখ্যাত সংলাপ কমবেশি সকলেরই জানা। যাত্রাপালা কবে থেকে শুরু হয়েছে তার সঠিক দলিল এখনো কারো জানা নেই। তবে ধারনা করা হয় বাংলার অষ্টম ও নবম শতকে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুন্ড্র, চন্দ্রদ্বীপ হারিকেল, শ্রীহট্টসহ এসব জায়গায় পালাগান ও কাহিনী কাব্যের প্রচলন ছিল। তখন রামউপাখ্যান, কৃষ্ণকথা, সীতার বনোবাস এসব কাহিনী কাব্য অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হতো। তখন পুরুষেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করতো। উপখ্যানকে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাকে পালাগান হিসাবে প্রচলিত ছিল।
অনুমান করা হয় পরবর্তীতে ‘পালা’ গানের দলের সঙ্গে ‘যাত্রা’ শব্দটি সংযোজন করা হয়েছে। ‘যাত্রা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ গমন বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া। তৎকালীন সময়ে পালাগানের বহর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তাদের প্রদর্শনী করতো। যাত্রাদল বা পালাগানের দলে ত্রিশ থেকে চল্লিশ জনের বহর থাকে। তারা তাদের বহর নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতো প্রদর্শনীর জন্য। হতে পারে ধর্মীয় অনুভুতি বা পুরাকালে সংস্কৃত বাহুল্যের কারণে শ্রুতিমধুর করতে যাত্রা শব্দটি পালা শব্দের প্রথমে সংযোজন করা হয়েছিল। সেই থেকে ‘যাত্রাপালা’ প্রচলিত হয়েছে।
ব্যাকরণগত ভাবে যাত্রা শব্দটির উদ্ভব হয়েছে সংস্কৃত ‘যা’ ধাতু থেকে। যার অর্থ গমন করা। তাই ‘যাত্রা’ শব্দটি গমনার্থক। হিন্দু ধর্মীয় নিয়মানুসারে দেখা যায় বাৎসরিক পুজা বা ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষ্যে দেবতাকে রথে, শকটে অথবা শিবিকায় চড়িয়ে ভক্তেরা বিশেষ নাটগীত করতে করতে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন করতো। যেটা এখনো বিদ্যমান। যেমন জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা, শিব ঠাকুরের গোলক যাত্রা, শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠযাত্রা, রাধা-কৃষ্ণের দোলযাত্রা, মনসা মঙ্গলে ভাসান যাত্রা এখনো প্রচলিত রয়েছে। হতে পারে দেবতাদের পবিত্র এই শোভাযাত্রা থেকে পালাগানের প্রথমে ‘যাত্রা’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। (চলবে)