এইচ এম এরশাদ
আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা সংবাদ প্রতিবেদন:
ইহুদিরা একটি প্রাচীন সেমিটিক জাতি, যাদের ইতিহাস শুরু হয় প্রায় ৪ হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানান অঞ্চল (বর্তমান ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, লেবানন ও সিরিয়ার কিছু অংশ) থেকে। ধর্মীয়ভাবে তারা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর অনুসারী এবং পরবর্তীতে হযরত মুসা (আ.)-এর মাধ্যমে তারা তৌরাত প্রাপ্ত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে তারা বিভিন্ন সাম্রাজ্যের দ্বারা দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর হাতে ৬০ লক্ষ ইহুদি গণহত্যার শিকার হয়—যা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই পটভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবি জোরালো হয়।
ইসরায়েলের জন্ম:
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাস করে—একটি ইহুদি রাষ্ট্র, অন্যটি আরব রাষ্ট্র। ইহুদিরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেও ফিলিস্তিনিরা ও আরব দেশগুলো তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করে, যার সাথে সাথেই আরব দেশগুলোর সাথে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। এর ফলেই বহু ফিলিস্তিনি নিজেদের ভিটেমাটি হারায়, যাকে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় বলা হয়।
জাতিসংঘের ভূমিকা:
জাতিসংঘ এই সংকট নিরসনের জন্য একাধিক রেজুলেশন গ্রহণ করলেও বাস্তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কাউন্সিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহুবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই ভেটো প্রয়োগ করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখে। ফলে জাতিসংঘের প্রভাব অনেকাংশেই সীমিত থেকে গেছে।
আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া:
প্রথম দিকে আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধ করেছে। তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। ২০২০ সালে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এখনও কাতার, ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চলছে।
ইসরায়েলের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা:
ইসরায়েল বর্তমানে একটি চরম ডানপন্থী সরকারের অধীনে রয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তাঁর সরকার ফিলিস্তিন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং গাজা ও পশ্চিম তীরের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তিনি এখনও ক্ষমতায় টিকে আছেন। পাশাপাশি, ইসরায়েলি সমাজে রাজনৈতিক মেরুকরণ, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার বিতর্ক ও যুদ্ধনীতির বিরোধিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনাও বেড়ে চলেছে।
গাজায় হামলার বাস্তবতা:
ইসরায়েল বারবার গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালায়। গাজা বর্তমানে হামাসের নিয়ন্ত্রণে, যাকে ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলো ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। হামাসের রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েল ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ দাবি করে বিমান হামলা চালায়। তবে এই হামলায় বহু নিরীহ শিশু, নারী ও বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়, যার ফলে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে।—
উপসংহার:
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুধুমাত্র একটি ভৌগলিক বা রাজনৈতিক সমস্যা নয়; এটি ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং জাতিগত সত্তার জটিল সংঘাত, যা গত শতাব্দীজুড়ে রক্তপাতের জন্ম দিয়েছে। স্থায়ী সমাধান পেতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন দুই পক্ষের আন্তরিক সংলাপ ও পারস্পরিক স্বীকৃতি।