বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে ইনমাস গোপালগঞ্জসহ দেশের ৪০টি সেবা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একযোগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন প্রায় ২৫০০ বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
বাপশকের কর্মকর্তারা জানান, এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য শুধুমাত্র দাবি আদায় নয়, বরং দেশের পরমাণু বিজ্ঞান ও গবেষণার ভবিষ্যৎ রক্ষা করা। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি, উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং ন্যায্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে এই আন্দোলনে নেমেছেন। তারা বলেন, “যদি উচ্চতর কর্তৃপক্ষ দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তবে আমরা কলম বিরতি এবং সেবা বন্ধ করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হব।”
কমিশনের অবদান ও গুরুত্ব: বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ নম্বর আইনের মাধ্যমে এর কার্যক্রম আধুনিক ও আইনগত কাঠামোর আওতায় আনা হয়। কমিশনের আওতায় পরমাণু গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা, বিকিরণ সেবা, চিকিৎসা, কৃষি ও শিল্পখাতে বিশেষায়িত সেবা প্রদান করা হয়।
কমিশনের সেবার মধ্যে রয়েছে: স্বল্পমূল্যে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসা, টিস্যু ব্যাংকিং, আমদানিকৃত খাদ্যে তেজস্ক্রিয়তা নিরূপণ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ জীবাণুমুক্তকরণ, গবেষণামূলক বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক মানের রিসার্চ রিঅ্যাক্টর পরিচালনা।
সংকটের চিত্র: কমিশনের শীর্ষ পদগুলো দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় নীতিনির্ধারণে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিজ্ঞানীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে পারছেন না, কারণ ২০১১ সালে কমিশনের নিজস্ব ‘জিও’ প্রদানের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ফলে, প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে এবং কর্মকর্তারা নিজেদের সুবিধার জন্য মনোনয়ন নিচ্ছেন, যা তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে।
কমিশনের বিজ্ঞানীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমতুল্য হলেও তারা সমপর্যায়ের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদ গ্রেড-৩ থেকে নামিয়ে গ্রেড-৪ এ রূপান্তর করা হয়েছে, যা প্রশাসনিক এবং আর্থিক বৈষম্য তৈরি করছে।
রূপপুর প্রকল্পে কমিশনের অবমূল্যায়ন: রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে কমিশন মালিক সংস্থা হয়েও এখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি থেকে বাদ পড়ছে। বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করার ক্ষেত্রে কমিশনের পরিবর্তে পিডিবি ও এনপিসিবিএল-কে সামনে আনা হচ্ছে, যা আইনবিরোধী এবং কমিশনের অধিকার খর্বের সমান।
iBAS++ বিতর্ক: সরকার iBAS++ সিস্টেম চাপিয়ে দেয়ায় কমিশনের মার্চ মাসের বেতন-ভাতা, পেনশন ইত্যাদি বন্ধ রয়েছে। এ কারণে প্রায় ৬০০ বিজ্ঞানীসহ ২৫০০ জন কর্মী চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো অর্থ ছাড়ের কোনো নিশ্চয়তা না আসায় কমিশনের আর্থিক কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞানীদের আহ্বান: তারা জোর দিয়ে বলেন, "আমরা আরেকটি স্বাধীনতা চাই না, চাই আমাদের পেশাগত মর্যাদা, অধিকার এবং গবেষণার পরিবেশ রক্ষা হোক।" তরুণ বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ, বিশেষ ভাতা, গৃহ ঋণ, গবেষণাগার আধুনিকীকরণ ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
কমিশনের বিজ্ঞানীরা গত ৫০ বছর ধরে নিরলসভাবে দেশের পরমাণু বিজ্ঞানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। তাদের দাবি, "আমাদের এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়; এটি ন্যায্য অধিকার এবং দেশীয় বিজ্ঞান ও গবেষণার ভবিষ্যৎ রক্ষার প্রশ্ন।"