গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির:-
(আমরা সবাই জানি লোভ করলে পাপ হয়। অর্থাৎ সবকিছুর মূলে লোভ কাজ করে। সুদ বলুন,ঘুষ বলুন, দুর্নীতি বলুন ,অন্যায় বলুন আর জুলুম বা অবিচার, মিথ্যাচার সবই হয় লোভের কারণে)
লোভ করলে পাপ হয়, আর পাপ মরণ ডেকে আনে। এই তো এর সাদামাটা মর্ম। লোভ মানুষের এক স্বভাবজাত বিষয়। স্বভাব ও চরিত্রের অন্যান্য মন্দ বিষয়ের মতো এই লোভকেও তাই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নিয়ন্ত্রণহীন লোভ পরিণতিতে ধ্বংস ডেকে আনবেই। লোভ যে কতটা ভয়াবহ পরিণতির মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিতে পারে এর নজির তো আমরা প্রতিদিনই পাই। আমাদের পত্রিকার পাতাগুলোতে অন্য কিছুর সংবাদ থাকুক আর না থাকুক, লোভের এ জঘন্য পরিণতির কথা থাকাটা যেন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যত দুর্নীতি, সবকিছুর মূলেই তো এই মরণব্যাধি লোভ। এইডসের মতোই একটি ঘাতক ব্যাধি লোভ। ক্ষমতার দাপটে, অর্থ-বিত্তের দাপটে, পদমর্যাদার দাপটে মানুষ নির্দ্বিধায় এ লোভকে কাজে লাগায়। ওঠাবসা চলাফেরায় দুর্নীতিই হয় তার সঙ্গী। এ সঙ্গলাভের ফল হিসেবে দুনিয়ার আদালতেই তাকে দাঁড়াতে হয় আসামীর কাঠগড়ায়। যে যত দাপটের সঙ্গেই দুর্নীতি করে যাক, দুর্নীতির জাল সে যতদূরই ছড়িয়ে দিক, এ পৃথিবী তাকে আসামী বানিয়েই ছাড়ে। আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীর কথাই যদি বলি, কিংবা আরও ছোট করে যদি শুধু শেষ হতে চলা ২০২৪ সালের কথাই বলি, তবুও কি এর দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে কম? কি দেশে আর কি বিদেশে, সর্বত্রই এই দৃশ্য। দীর্ঘ ১৬ বছর (বৈধ /অবৈধ) ভিন্ন কথা প্রধান মন্ত্রী লোভের আঘাতে ছিটকে পড়েন সিংহাসন থেকে। কোটি কোটি টাকার মালিক যারা, তাদের নামে দায়ের হয় দুর্নীতির মামলা। গতকাল যিনি রাজক্ষমতা আঁকড়ে ধরে উড়ে বেরিয়েছেন সদাসর্বত্র, তাকে আজ অন্য দেশে চলে যেতে হল, অন্যরা ঘুরে ঘুরে যেতে হয় বিচারকের এজলাসে।
দেশের আগের প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির অপরাধে ছিল জেলে , ছিল গৃহবন্দী। এমন আরও কত কী! আসল কথা কী, লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা সেখানে বেকার। তাই তো আমরা দেখি, দুর্নীতির যত অভিযোগ, সবই সম্পদশালীদের বিরুদ্ধে। বরং যে যত বেশি দুর্নীতিপরায়ণ, সে ততটাই সম্পদশালী। এই জগতে হায়, সেই বেশি চায়, যার আছে ভূরি ভূরি। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছেন এভাবে- ” আদম সন্তানের যদি দুই উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে সে কামনা করে- তার যদি আরেকটি উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকত! মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তার মুখ পূর্ণ করতে পারবে না! “-জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৩৭ লোভের একটা স্তর তো এমন- কেউ অর্থসম্পদের পেছনেই তার জীবনকে ব্যয় করে দিল। নাওয়া-খাওয়া জীবনের সুখ-আরাম ভুলে গিয়ে কেবলই টাকা আর টাকা! অধিক সম্পদ উপার্জনের লোভে যে এভাবে নিজেকে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিলিয়ে দেয়, নিজের উপার্জিত টাকা সে আর ভোগ করে যেতে পারে না। এখানে অবশ্য ব্যক্তি কেবল তার নিজের আরামকেই হারাম করে, অন্য কেউ তার দ্বারা আক্রান্ত হয় না। লোভের আরেকটি স্তর হচ্ছে- নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে অন্যকে আক্রান্ত করা, প্রভাব খাটিয়ে কিংবা কোনো কৌশলে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। লোভের উপরোক্ত প্রথম স্তরটিও প্রশংসনীয় নয় মোটেও, কিন্তু দ্বিতীয় স্তরটি সম্পূর্ণই হারাম। বলে-কয়ে হোক আর গোপন চক্রান্তের মাধ্যমে হোক, সর্বক্ষেত্রেই তা নিন্দনীয়, অবৈধ। এ লোভই মানুষের পতন ডেকে আনে। দাপট হয়তো কিছুকাল তাকে সঙ্গ দেয়। কিন্তু একসময় তাকে পতনের মুখে পড়তেই হয়। তবে এটাও অনস্বীকার্য- জীবনে চলতে গেলে টাকা লাগেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই সমাধান দিচ্ছেন-
“হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার জন্যে নির্ধারিত রিজিক পূর্ণ না করে ততক্ষণ তার কিছুতেই মৃত্যু হবে না। একটু দেরিতে হলেও তা তার কাছে পৌঁছবেই। তাই আল্লাহকে ভয় করো। উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। হালাল যতটুকু তা গ্রহণ করো আর যা কিছু হারাম তা বর্জন করো।” -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৪৪ এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লোভের দুটি স্তর থেকেই বেঁচে থাকার পথ নির্দেশ করেছেন। তিনি একদিকে উচ্চারণ করেছেন আশ্বাসবাণী- তোমার জন্যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতটুকু রিজিক নির্ধারিত, তা তুমি পাবেই। যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণরূপে তুমি তা ভোগ না করবে ততক্ষণ তোমার মৃত্যু হবে না। এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তুমি আল্লাহকে ভয় করে চলো আর সহজে যতটুকু সম্ভব উপার্জনের চেষ্টা করো। উপার্জনের পেছনে পড়ে তুমি তোমার জীবনকে নিঃশেষ করে দিয়ো না। এ জীবন অনেক মূল্যবান; একে কাজে লাগিয়েই তোমাকে অর্জন করতে হবে মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত জীবনের পাথেয়। দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন, উপার্জন করতে গিয়ে হালাল-হারাম দুটি পথেরই তুমি সন্ধান পাবে। আল্লাহকে ভয় করে সর্বপ্রকার হারাম থেকে তুমি বেঁচে থেকো। হালাল পন্থায় যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকুই তুমি অবলম্বন করো। হয়ত একটু বিলম্ব হবে, কিন্তু তোমার নির্ধারিত রিজিক তোমার কাছে আসবেই। সম্পদের প্রতি এই লোভের একটি অনিবার্য ফল- সম্পদ অর্জনে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। এর সঙ্গে যোগ হয় । একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনের এগিয়ে যাবার মানসিকতা; হালাল-হারামের বাছ-বিচার না করে শুধুই সম্পদ বাড়ানোর প্রবণতা, জন্ম নেয় একের মনে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা প্রভৃতি। এভাবে একটি মন্দ বিষয় আরও অনেক মন্দ বিষয়ের সূত্রপাত ঘটায়। আর একে একে যখন কেউ আক্রান্ত হয় লোভ হিংসা বিদ্বেষ প্রভৃতি রোগে, তখন তার পতন ঠেকাবার উপায় কোথায়! এভাবেই মনের কোণে লালিত লোভ একসময় ভয়ানক রূপ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে ধ্বংসের দুয়ার খুলে দেয়। দুনিয়াতে যেমন লোভ একরাশ মন্দত্বের সূচনা করে, একইভাবে তা দ্বীন-ধর্ম ও পরকালকেও বরবাদ করে দেয়। ওই যে বলে এলাম, লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয় এবং তার বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে যায়, ওই সময়ে সে যা কিছুই করে, বিবেকের কাঠগড়ায় আসামী রূপে তাকে দাঁড়াতে হয় না। তখন তার কাছে কোনো অপরাধই অপরাধ মনে হয় না। সেসময় যেমন সে কালো টাকা হাতিয়ে নিতে থমকে দাঁড়ায় না, ঠিক তেমনি প্রয়োজন হলে দ্বীন-ধর্ম উপেক্ষা করতে, এমনকি কখনো ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। সম্পদের নেশায়, সচ্ছল জীবন লাভের আশায় আমাদের এই দেশেই তো কত মানুষ খ্রিস্টান মিশনারীদের পাতা জালে জড়িয়ে যাচ্ছে! নবীযুগের একটি দৃষ্টান্ত দিই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মদীনায়। সেসময় নাজরান ছিল খ্রিস্টানদের এলাকা। সেখান থেকে ষাট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রওয়ানা দিল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে। তাদের মধ্যে তিনজন ছিল খুবই গণ্যমান্য। একজন ছিল সর্বাধিক বিজ্ঞ, যে কোনো কাজে অন্যরা তার পরামর্শই মেনে চলত। আরেকজন ছিল তাদের আলেম। তৃতীয় জন ছিল পাদ্রী এবং তাদের ধর্মীয় নেতা। তার নাম আবু হারেসা। অনন্য মর্যাদার অধিকারী এক ব্যক্তি। তৎকালীন পরাশক্তি খ্রিস্টান রাষ্ট্র রোমও তাকে অনেক মর্যাদার আসনে আসীন করেছিল। তাকে ধনসম্পদে ভরে তুলেছিল। তার জন্যে তারা গীর্জা বানিয়ে দিয়েছিল। খ্রিস্টান ধর্মে তার জ্ঞান ও পারদর্শিতায় রোমবাসী ছিল যারপরনাই মুগ্ধ। যাই হোক, এই কাফেলা যখন নাজরান থেকে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হল, তখন হঠাৎ করেই আবু হারেসাকে বহনকারী খচ্চরটি তাকে নিয়ে পড়ে গেল। তখন পাশে থাকা তার সহোদর বলে উঠল : যার অর্থ মুহাম্মাদ ধ্বংস হোক। আবু হারেসা তখন শাসিয়ে তাকে বললেন, তুমি ধ্বংস হও! অবাক হয়ে তার সফরসঙ্গী জানতে চাইল- কেন ভাই? আবু হারেসা বললেন, আল্লাহর কসম, তিনিই তো সেই নবী, আমরা যার জন্যে প্রতীক্ষমাণ। সফরসঙ্গীর পাল্টা প্রশ্ন- আপনি যদি তা জেনেই থাকেন, তাহলে কেন আপনি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না? আবু হারেসার সোজা জবাব- এই যে রোমবাসী আমাদেরকে এত সম্মান করছে, আমাদেরকে নেতা বানিয়ে রাখছে, অর্থ কড়ি দিচ্ছে, এই খ্রিস্টধর্ম অনুসরণ না করলে তো তারা এগুলো করবে না। আমি যদি ইসলাম গ্রহণ করি তাহলে তারা এই অর্থসম্পদ ইজ্জত-সম্মান সবই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।… (আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৩৯০৬; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৬৬৫
(৩/৪২) । আহলে নাজরানের প্রতিনিধিদল শিরোনাম দ্রষ্টব্য; তাফসীরে রাযী, সূরা আলে ইমরানের প্রারম্ভিক আলোচনা দ্রষ্টব্য) । এ তো খ্রিস্টানদের একটি দল কিংবা বিশেষ একজন ব্যক্তির ঘটনা। কিন্তু পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে ব্যাপকভাবেই আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খ্রিস্টানদের এ চরিত্রের কথা বলা হয়েছে, “সত্যি, যারা আল্লাহর (সঙ্গে কৃত) অঙ্গীকার ও নিজেদের শপথের বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে, পরকালে তাদের কোনো অংশ নেই; এবং আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, কিয়ামতের দিন তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন না; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৭৭ তাওরাত ও ইঞ্জিলে যে শেষ নবীর আগমনের কথা বলা হয়েছে, হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই যে সে শেষ নবী, এ নিয়ে ইহুদী-খ্রিস্টানদের কোনো সন্দেহ ছিল না। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন- ” যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তাঁকে চিনে, যেমন তারা তাদের ছেলে-সন্তানদের চেনে। আর তাদের একটি দল জেনে-শুনেই সত্যকে লুকিয়ে রাখছে। -সূরা বাকারা (২) : ১৪৬ । প্রথম জীবনে ইহুদী আলেম থেকে পরবর্তী জীবনে বরেণ্য সাহাবী হয়ে ওঠা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-কে হযরত উমর রা. জিজ্ঞেস করেছিলেন- “আপনি কি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপনার ছেলের মতোই চেনেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন-“তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস বরং আমার ছেলের চেয়েও বেশি”। আল্লাহ তায়ালা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্যাবলিসহ পাঠিয়েছিলেন। সেসব বৈশিষ্ট্যের আলোকেই আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু আমার ছেলের বিষয়ে তো আমার নিশ্চিত জানা নেই, তার মা কী করেছে! (দ্র. তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা বাকারা, আয়াত ১৪৭-এর অধীনে) । তারা সুনিশ্চিতভাবেই চিনতেন- মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, তাওরাত-ইঞ্জিলে বর্ণিত শেষ নবী। হযরত মূসা ও ঈসা আলাইহিমাস সালামকে সমর্থনকারী তিনিই সেই রাসূল। অথচ নিজেদের নেতৃত্ব হারানোর আশংকায়, পার্থিব সম্পদের লোভে তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নেয়নি। এভাবেই দুনিয়ার প্রতি লোভ তাদের দ্বীন ও আখেরাত বরবাদ করে দিয়েছিল। এ ধারা এখনো চলমান। অধিক সম্পদ উপার্জনের নেশায় হালাল-হারামের বাছ-বিচার না করা, ধর্মীয় বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করার দৃষ্টান্ত আমরা যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখতে পাই। আল্লাহ তায়ালার আদেশ চিরন্তন- ” আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করো না। তোমরা যদি প্রকৃত সত্য উপলব্ধি কর তাহলে আল্লাহর কাছে যে প্রতিদান আছে তোমাদের জন্যে তা-ই শ্রেয়। তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী। যারা সবর করে আমি তাদের উৎকৃষ্ট কাজ অনুযায়ী অবশ্যই তাদের প্রতিদান দেব। -সূরা নাহল (১৬) : ৯৫-৯৬ মানুষ যেমন সম্পদের প্রতি লোভ কযে, তেমনি মর্যাদা ও সম্মানের প্রতিও লোভ করে। পদমর্যাদার প্রতি লোভ কখনো সম্পদের লোভের চেয়েও ভয়ানক হয়ে পড়ে। এ মর্যাদা পার্থিব বিষয় নিয়েও হতে পারে, হতে পারে দ্বীনি বিষয়েও। যেখানেই হোক, যেভাবেই হোক, এ লোভও মানুষের পতন ত্বরান্বিত করবেই। জাগতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্মান ও মর্যাদার আসন চেয়ে নিয়ে মানুষকে যে কতটা অপমান আর অসম্মান সঙ্গে করে সে পদ থেকে নেমে যেতে হয় তা তো আমাদের চোখে দেখা এক বাস্তবতা। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী- “হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরা! তুমি কখনোই নেতৃত্ব চেয়ো না। কারণ তুমি যদি চাওয়ার পর তা পাও তাহলে এর পুরো দায়িত্ব তোমার ওপরই ন্যস্ত করা হবে। আর না চেয়ে যদি তুমি তা পাও তাহলে (আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে) তোমাকে সে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬২২। মর্যাদার প্রতি লোভেরই একটি দিক- মানুষের প্রশংসা শুনতে চাওয়া। এটাও মানুষের একটা স্বভাবজাত বিষয়। অন্যরা যখন প্রশংসা করে তা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সংকট হয় তখন যখন কেউ কোনো কাজ না করেও সে জন্য প্রশংসা শুনতে চায় কিংবা কেউ তার প্রশংসা না করলে তাকে নানাভাবে কষ্ট দিতে থাকে”। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা এমন- “যারা নিজেদের কর্মকান্ড- নিয়ে উৎফুল্ল এবং যা তারা করেনি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে ভালোবাসে তুমি অবশ্যই তাদেরকে ভাববে না যে, তারা আজাব থেকে বেঁচে যাবে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি”। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮৮। মর্যাদার প্রতি লালসা যখন দ্বীনি কোনো বিষয় নিয়ে হয়, কোনো ইবাদত করে কেউ যখন মানুষের কাছে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে চায়, দান-সদকা করে, বারবার হজ¦-ওমরা আদায় করে কিংবা কাড়ি কাড়ি ইলম শিখে কেউ যখন অন্যদের দৃষ্টিতে সম্মানের আসনে বসতে চায়, তার মুক্তির তখন কোনো উপায় থাকে না। কোরআন-হাদীসের ঘোষণা অনুসারে দোজখই তার ঠিকানা! এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদের বিষয়ে ফয়সালা করা হবে, তাদের একজন শহীদ, একজন আলেম এবং একজন দান-সদকাকারী। শহীদকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হলে তিনি তাকে তাঁর নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তাতে কী আমল করেছ? সে উত্তর দেবে, আপনার পথে লড়াই করতে করতে আমি শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং লড়াই করেছ- যেন তোমাকে সাহসী বীর যোদ্ধা বলা হয়। এটা তো তোমাকে বলা হয়েছেই। তখন আল্লাহর আদেশে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর আলেমকে নিয়ে আসা হবে, যে নিজে ইলম শিখেছে, অন্যকে শিখিয়েছে এবং কোরআন তিলাওয়াত করেছে। তিনি তাকে তাঁর নিয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তাতে কী আমল করেছ? সে উত্তর দেবে, আমি নিজে ইলম শিখেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং কোরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি ইলম শিখেছ যেন তোমাকে আলেম (আল্লামা) বলা হয়। কোরআন পড়েছ যেন তোমাকে কারী বলা হয়। এগুলো তো বলা হয়েছেই। তখন আল্লাহর আদেশে তাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর নিয়ে আসা হবে ওই দান-সদকাকারীকে, যাকে আল্লাহ প্রচুর সম্পদ দান করেছিলেন। তিনি তাকে তাঁর নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্বীকার করবে। এরপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তাতে কী আমল করেছ? সে উত্তর দেবে, আপনি পছন্দ করেন এমন কোনো পথ নেই যেখানে আমি দান করিনি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং দান করেছ যেন তোমাকে দানবীর বলা হয়। এটা তো বলা হয়েছেই। তখন তাকেও আল্লাহর আদেশে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৫ ।
এই হচ্ছে লোভ। মোটকথা, অর্থ-সম্পদ নিয়ে হোক, আর সম্মান-মর্যাদা নিয়ে হোক, সকল লোভের ক্ষেত্রে সমানভাবে এ কথা প্রযোজ্য- লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। অথচ আল্লাহ তায়ালা যেভাবে মানুষের হায়াত-মওত সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা যেমন সুনির্ধারিত, ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষের জন্যেই তার রিজিকও নির্ধারিত। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। ওপরের এক হাদীসে আমরা দেখেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, এ নির্ধারিত রিজিক দুনিয়াতে পরিপূর্ণরূপে পাওয়ার আগে কিছুতেই কারও মৃত্যু হবে না। তাহলে আর লোভের পেছনে ছোটা কেন? অন্যের সঙ্গে শুধুই সম্মান আর সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা কেন? মুমিন বান্দার উচিত, নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তের সামনে সঁপে দেয়া। ‘দারুল আসবাব’ । এ দুনিয়াতে সহজতার সঙ্গে যতটুকু সম্ভব উপকরণ অবলম্বন করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয় পুরোটাই আল্লাহ তায়ালার হাতে ন্যস্ত করা। আর প্রয়োজন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তাকওয়া ও আল্লাহর ভয়কে অবলম্বন করে চলা। আল্লাহ তাআলার ঘোষণায় কোনো অস্পষ্টতা নেই- “কেউ যদি আল্লাহকে ভয় করে তাহলে তিনি তার জন্যে কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে তিনি এমন স্থান থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না”। -সূরা তালাক (৬৫) : ২-৩। আর মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়ে কোরআনের ভাষ্য- “যে ব্যক্তি মর্যাদা লাভ করতে চায়, (সে জেনে রাখুক-) সমস্ত মর্যাদা আল্লাহরই হাতে”। -সূরা ফাতির (৩৫) : ১০। লোভের অবশ্য প্রশংসনীয় কিছু ক্ষেত্রও আছে। যেমন, এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “লোভাতুর ও তৃষ্ণার্ত দুই ব্যক্তি, যারা কখনোই তৃপ্ত হয় না- ইলম অর্জনে যে নিমগ্ন, তার লোভ কখনো শেষ হয় না, দুনিয়া অর্জনে যে লিপ্ত, সেও কখনো তৃপ্ত হয় না”। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী হাদীস ৯৭৯৮ । দুনিয়া অর্জনে লোভ যতটা নিন্দনীয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ইলম অর্জনে সে লোভ ঠিক ততটাই প্রশংসনীয়। মহান আল্লাহ তায়ালা সকলকে লোভ – লালসা এবং অহংকার মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন, আমিন।