এম.মাসুম আজাদ,ঝিনাইদহ ব্যুরো:-
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে,উন্নত হয়েছে মানুষের জীবনযাপনের বিভিন্ন তৈজসপত্র। এতো কিছু উন্নয়নের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কিছু পেশা। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান মৃৎশিল্পের কুমারদের পেশা।কয়েক বছর আগেও একটু গ্রাম অঞ্চলের দিকে গেলে হাটে-বাজারে অহরহ দেখা মিলত মাটির তৈরি জিসিনপত্রের। কুমাররা ছোট-বড় বিভিন্ন নিত্যব্যবহারের জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসত। আর যদি একটু কুমারদের বাড়িতে উঁকি দেয়ার সুযোগ হয়,তবে দেখা মিলত অতি যত্নে নিপুণভাবে মাটির তৈজসপত্র বানানোর চিত্র। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে দিন-রাত ঘুরত কুমারের চাকা, পানিতে মিশত নরম কাদা, রোদে শুকাত হাঁড়ি-পাতিল, পোড়ানো হতো সেসব জিনিস আর আঁচড় পড়ত রং-তুলির। পরিবারের সবাই মিলে করত সেসব কাজ। এমন অসংখ্য পরিবার আছে যারা বংশপরম্পরায় কয়েক পুরুষ ধরে চালিয়ে এসছে দেশের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই কাজ। এসব এখন রূপকথার গল্প মনে হতে পারে।
কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতা হলো প্রায় বিলুপ্তির পথে দেশের এই প্রাচীনতম এই কুমার পেশা। যারাও বা বাপ-দাদার পেশাকে ধরে রাখতে চালিয়ে যাচ্ছেন মৃৎশিল্পের কাজ, তাদের অবস্থাও খুব একটা বলার মতো নয়। হয় তাদের অন্য কোনো কাজ করার সামর্থ্য নেই অথবা পরিবারের অসচ্ছলতায় বাধ্য হয়ে করে যাচ্ছেন এই কাজ।
আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে অন্য কোনো ঐতিহাসিক ও প্রাচীন শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কি-না, তা কি আমরা কখনও ভেবেছি? বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্যবৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যাসহ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে, বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প।
শুধু তাই নয়- প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এসব তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন চাহিদা হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।
বর্তমানে অল্প যেটুকু মৃৎশিল্পের অস্তিত্ব মেলে, তা ওই গ্রামীণ মেলা আর পূজায়। বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টে যেই মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয় তা প্রাচীন মৃৎশিল্পের থেকে কিছুটা দূরে। এগুলো মূলত অটোমেশিন দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা করলে হারিয়ে যেতে বসা এ মৃৎশিল্পই হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কারণ সারাবিশ্বেই এ শিল্পের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। ২০০০ সালের পর থেকে বেড়েছে বাংলাদেশের মৃতশিল্পের রপ্তানি। এখন ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় রপ্তানি হচ্ছে আমাদের মৃৎশিল্পের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বিদেশে মূলত মাটির তৈরি ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গার্ডেন প্রডাক্ট, নাইট লাইট, ডাইনিং আইটেম, ইনডোর গার্ডেন আইটেম, ফুলদানি, মাটির টব ও মাটির ব্যাংকের চাহিদা রয়েছে। গুণগতমান দিয়েই দেশের বাইরেও মৃতশিল্পের চাহিদা আরও বৃদ্ধি করতে হবে, তবেই শুধু আমাদের এ ঐতিহ্য ইউরোপ-আমেরিকার ড্রয়িংরুমে কিংবা বেডরুমে শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে।
মাটির তৈরি তৈজসপত্র বাংলা ও বাঙালির প্রাচীনতম একটি ঐতিহ্য। যার রয়েছে সোনালি অতীত। কুমার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় অনন্য হয়ে উঠুক আমাদের মাটির দেশের এই মাটির শিল্প। মা আর মাটির সঙ্গে এদেশের মানুষের যে নাড়ির টান তা যেন ছিড়ে না যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। সরকারি ভাবে সহজ শর্তে এই পেশাদার'দের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হোক তাহলে তারা আরো স্বচ্ছন্দ ভাবে বাপ দারার ঐতিহ্য পেশা ধরে রাখতে পারে বলেই মন্তব্য করেন একাধিক কুমার।