মুফতি আশরাফুল ইসলাম খুলনা প্রতিনিধি:-
নতুন বছর বা ইংরেজি নববর্ষ ধর্মীয় দিক থেকে কোনো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। তবে যেহেতু ইংরেজি বছর দিয়ে এদেশে হিসাবনিকাশ চলে তাই বছর শেষ হলে একজন মুসলিমের জীবনেও প্রভাব পড়ে। বছর শেষে অনেকে নতুন বছর শুরু করার সংকল্প করতে পারে এবং জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে।
একজন মুমিনের জন্য নতুন বছর মানে শুধু ক্যালেন্ডার পরিবর্তন নয়, বরং নিজের ইবাদত, আখলাক ও জীবনধারার দিকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য রাখার সময়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা এবং এর মধ্যে সব বিষয়কেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি সময়ের মূল্যও ইসলামে বিশেষভাবে উল্লিখিত। তাই নতুন বছরে একজন মুমিনের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহর প্রতি তওবা ও ক্ষমা চাওয়া
নতুন বছরের শুরুটা হতে পারে আল্লাহর কাছে তওবা করার, গত বছরের ভুলত্রুটি ও গুনাহ মাফ চাওয়ার একটি দারুণ সুযোগ। সূরা আল-ফুরকান (২৫:৭৪)-এ আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তারা যারা বলে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের নফসের অশুদ্ধতা ক্ষমা কর এবং আমাদের কর্মের মধ্যে সবচেয়ে ভাল অংশটি দান কর।’।” একান্তভাবে আল্লাহর কাছে নিষ্ঠার সাথে তওবা করলে নতুন বছরটি আল্লাহর কাছ থেকে আরও বেশি রহমত ও বরকতের হতে পারে।
নিজেকে বদলানোর সংকল্প নেয়া
এটি একটি দারুণ সময় নতুন সংকল্প নেওয়ার। একজন মুমিনের জীবন ঈমান ও সৎকর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। ইসলামে পাপ ও গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতিদিন চেষ্টার কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং, নতুন বছরটি এমন একটি সময় হতে পারে যখন আপনি আপনার আখলাক ও জীবনযাপন বদলানোর সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনি যদি অন্যকে সঠিকভাবে ইসলামের পথে আহ্বান করতে চান, তাহলে আপনিও সৎকর্মে নিয়োজিত থাকতে হবে।
ঈমান ও ইবাদত বৃদ্ধি করা
নতুন বছর মানে শুধু আমাদের জীবনকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করা নয়, বরং এটি ঈমান ও ইবাদতের দিক থেকেও নিজেকে নতুনভাবে গঠন করার সুযোগ। নামাজ, রোজা, দান, হজ বা অন্য কোনো ইবাদত যে জ্ঞান ও আস্থা নিয়ে করতে হয়, তা নিয়ে নতুন বছরের পরিকল্পনা করা উচিত।
নিজের সময়ের মূল্য দেয়া
নতুন বছরটি আমাদের সময়ের মূল্যবান ব্যবহার সম্পর্কে ভাবার সময় হতে পারে। ইসলাম সময়ের গুরুত্ব অনেক গুরুত্বের সাথে আখ্যায়িত করেছে। নবীজি (স.) বলেন, ‘দুই নেয়ামত রয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত থাকে, একটি হলো সুস্থতা এবং অন্যটি হলো সময়।’ (বুখারি) একজন মুমিনের কাজ হলো সময়ের সদ্ব্যবহার করা, বিশেষ করে ইবাদত, কাজ ও পরিবারকে নিয়েই।
পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন
ইসলামে পরিবারের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন বছরটি আপনার পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বগুলো গুরুত্ব সহকারে পালন করার সময় হতে পারে। সূরা তাহা (২০:৭২) অনুযায়ী, একজন মুমিন তার পরিবারকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অশ্লীলতা ও অবাধ আনন্দ
নতুন বছর উপলক্ষে অনেকেই পার্টি ও মাদকাসক্তির দিকে চলে যায়, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অবাধ আনন্দ ও অশ্লীলতা একেবারেই মুমিনের জীবনধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ঈমানের ভিত্তিতে কাজ করে, সে তার জীবনকে পরিপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ করে তোলে।’ (তিরমিজি)
নতুন বছর উদ্যাপনকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে গ্রহণ করা
ইসলামে আমাদের কোন নববর্ষ বা নতুন বছরের উৎসব উদ্যাপন করার নির্দেশনা নেই। এমনকি, নবী (সা.) বা সাহাবিরা কখনোই ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপন করেননি। যদি আমরা এটি কোনো ধর্মীয় উৎসব হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে সেটা শিরক হতে পারে, যেহেতু আমরা কোনো নতুন বছরে কেবল উদ্যাপনের জন্য বিশেষ দিন পালন করি যা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ।
অপচয় বা দান খয়রাতের অবহেলা
অনেক সময় নতুন বছরে বিভিন্ন বিলাসিতা বা অপ্রয়োজনীয় খরচ হতে পারে। এটি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়, যা ইসলামে হারাম (নিষিদ্ধ)। সুরা বনি ইসরাইলের ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ অপচয় করে, সে শয়তানের ভাই।’
নিজের আত্মসম্মান ও গর্ব বৃদ্ধি করা
নতুন বছরে নিজের উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা করাটা ভাল, তবে নিজের আত্মসম্মান বা অহংকার বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আত্মতুষ্টি গ্রহণ করা ভুল হবে। ইসলামে গর্ব করা নিষিদ্ধ, নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এক চিমটি অহংকার নিয়ে মরে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম)
পূর্ববর্তী বছরের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা না নেয়া
নতুন বছরে সবচেয়ে বড় ভুল হতে পারে পূর্ববর্তী বছরের ভুলগুলো থেকে কিছু না শেখা। নবীজি (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তার বান্দার তওবা কবুল করেন, যখন সে সাচ্চা দৃষ্টিতে পুনরায় আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’ (তিরমিজি) যদি একজন মুমিন তার পূর্ববর্তী বছরের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে তা তাকে পুনরায় ভুল পথে চালিত করতে পারে।
নতুন বছর একজন মুমিনের জীবনে হতে পারে একটি নতুন শুরু, একটি সুযোগ আল্লাহর কাছে আরও কাছাকাছি আসার এবং নিজের জীবনকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী সঠিক পথে পরিচালিত করার।
এই বছরটিকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের, সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়ার এবং সময়ের সদ্ব্যবহারের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। তবে, সেইসাথে মুসলিমদের উচিত নতুন বছরের উপলক্ষে এমন কিছু করা যা ইসলামের বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা তাদের অন্তরের উন্নতি ও শান্তি আনবে।
লেখক
হাফেজ মাওঃ মুফতি আশরাফুল ইসলাম
বিশিষ্ট মোফাচ্ছেরে কোরআন
ইসলামি আলোচক,খুলনা