প্রতিনিয়ত খবরের শিরোনাম হচ্ছে জঙ্গি হামলা। বিংশশতাব্দীর আধুনিক সময়ে একের পর এক শিক্ষিত যুবসমাজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন্ত্রে দিক্ষীত হচ্ছে ভাবতে অবাক লাগে। বিশ্বায়নের এই যুগে ধর্মের নামে কুচিন্তা মাথায় নিয়ে একের পর এক মানুষ মারার মহোৎসবে মত্ত হচ্ছে জঙ্গীরা। এমন একটি সময়ে মনে পড়ে যায় উত্তরাধুনিক যুগে জন্মনেয়া এক গরীব কৃষক সন্তান আরজ আলী মাতব্বরের কথা। আজ থেকে একশত উনিশ বছর আগে ১৯০০ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশের ভাটি অঞ্চলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে জন্মেছিলেন তিনি। বরিশাল জেলার লামচরি গ্রামের এন্তাজ আলী মাতুব্বরের ২ ছেলে মারা যাবার পর ঘর আলো করে আসে আরজ আলি মাতব্বর। কিন্তু ছেলের ৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। একটি টিনসেডের বাড়ি ও ৫ বিঘা জমি নিয়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় বিধবা মায়ের জীবনযুদ্ধ। ১৯১০ সালে জমির খাজনা দিতে না পারলে এই সামান্য জমিটুকু নিলামে চড়িয়ে জমিদাররা দখল করে নেয়। বেঁচে থাকার জন্য আরজ আলী মাতব্বরের মা বরিশালের কুখ্যাত সুদের কারবারি জনার্দন সেনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করেন। এই দেনার দায়ে ১৯১১ সালে জনার্দন সেন তাদের টিনের বসত বাড়ি নিলাম করে নেয়। তবে ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেননি।
লামচরি গ্রামের আবদুল করিম মুন্সী নামে এক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি নিজ বাড়িতে একটি মক্তব খুলেছেন। আরজ আলী মাতব্বর তের বছর বয়স পর্যন্ত অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। এই অক্ষর পরিচয়হীন বালকের মক্তবের আশেপাশে ঘোরাফেরা এবং পড়াশোনায় আগ্রহ বুঝতে পেরে আবদুল করিম মুন্সী আরজ আলী মাতব্বরকে বিনা বেতনে মক্তবে ভর্তি করে নেন। পড়ালেখায় প্রবল আগ্রহ দেখে তাঁর এক জ্ঞাতি চাচা ‘সীতারাম বসাক লিখিত আদর্শলিপি’ বই কিনে দেন। কিন্তু আরজ আলীর পড়ালেখা শুরু হতে না হতেই অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় আবদুল করিম মুন্সীর মক্তবটি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তিনি পৈত্রিক পেশা কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। কৃষি কাজের ফাঁকে তিনি জমি মাপজোকের আমিনের কাজ শিখে নেন। পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে কৃষি কাজের পাশাপাশি আমিনী পেশা শুরু করেন। তবে থেমে থাকেনি পড়ার প্রতি আগ্রহ। শিক্ষার ক্ষুধা মেটাতে তিনি বরিশাল শহরের পরিচিত ছাত্রদের পুরনো বইপত্র সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করেন। এছাড়া বরিশাল শহরের পাবলিক লাইব্রেরীতে তিনি নিয়মিত পাঠক হয়ে যান। লামচরি গ্রাম থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে তিনি প্রতিদিন লাইব্রেরিতে পড়ালেখা করতেন। এছাড়া বরিশালের শঙ্কর লাইব্রেরি থেকে টানা ৩ বছর বই নিয়ে পড়েছেন। সে সময় খ্রিষ্টান মিশনারীদের ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’ নামে একটি লাইব্রেরি থেকেও বই নিয়ে পড়তেন। এই লাইব্রেরির দায়িত্বরত স্কটল্যান্ডবাসী মিস্টার মরিস টানা ৬ বছর আরজ আলী মাতুব্বরকে জ্ঞান পিপাসা মেটাতে বই দিয়ে সর্বতোভাবে সহযোগীতা করেছেন। এছাড়াও বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির কলেজ লাইব্রেরি থেকে বই লেনদেনে সহযোগীতা করেছেন। পড়ার প্রতি আগ্রহ এমন ছিল যে তিনি মাঠে লাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে বই পড়তেন। কারো সঙ্গে পথ চললে তিনি কখনো আগে হাঁটতেন না, তিনি বলতেন, কারো পিছনে হাঁটলে চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া যায়।
১৯৩২ সালে আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে। বলা যায়, এটাই ছিল তার জ্ঞানালোক বোধ বিকাশিত হবার উপযুক্ত সময়। এ সময় মনের ভেতরের ভেজানো দরজা খুলে বেরিয়ে আসে চেতনার উন্মেষ। এবছর তার একমাত্র আশ্রয় মায়ের মৃত্যু ঘটে। জীবনের সবচেয়ে আপনজনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তাঁর মৃত মায়ের ছবি তুলে রাখতে চাইলেন। গ্রামের লোক তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস অনুযায়ী এই ছবি তোলার প্রতিবাদস্বরূপ তাঁর মায়ের জানাজা বর্জন করে। তখন কাছের মানুষদের সাহায্যে মায়ের জানাজা সম্পন্ন করেন তিনি। ধারনা করা হয়, এই ঘটনা আরজ আলী মাতুব্বরের অনুভুতিপ্রবণ মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যা পরবর্তীকালে তাঁকে সুসংহত হতে এবং মুক্তবুদ্ধিচর্চায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে।
১৯২৩ সালে তিনি প্রথম পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। বই গুছিয়ে যতেœ রাখার জন্য আলমারি কেনার সামর্থ ছিলনা বলে বৈঠক খানার তাকে বইগুলি সাজিয়ে রাখতেন। ১৯২৩-৪১ এই ১৮ বছরে তার বইয়ের সংগ্রহ ছিল নয়শত। কিন্তু ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে এক ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়ে আরজ আলী মাতুব্বরের বৈঠকখানা এবং সেই সঙ্গে তার যতেœ সাজিয়ে রাখা পাঠাগারের সকল বই উড়িয়ে নিয়ে যায়। একটি বইও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পারেননি তিনি। এতে তিনি আশাহত না হয়ে বরং জীবনের এই মর্মান্তিক বাস্তবতাকে পরম অভিজ্ঞতা হিসাবে মেনে নিয়ে পুনরায় বই সংগ্রহে মননিবেশ করেন। নিরলস হাড়ভাঙা খাটুনি আর অসীম মনোবল নিয়ে পরবর্তী সতের বছরে বই সংগ্রহের সংখ্যা দাঁড়ায় চারশত। ঠিক সেই সময় ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আবারও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্নিঝড়ে একই ভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায় সংগৃহীত বইগুলি। এরপর দীর্ঘ একুশ বছর কঠিন শ্রম আর ধৈর্য্যরে সাথে তিনি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন। এবার শুধু বই সংগ্রহে মনোনিবেশ করে ক্ষ্যন্ত যানসিন। ১৯৭৯ সালে বই রাখার জন্য মজবুত দালান নির্মান করেন এবং এই দালানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’।
আরজ আলী মাতুব্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষক কাজী নুরুল ইসলামের সহযোগিতায় একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ক্লাশ নিয়েছিলেন। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষর্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর লেকচার শুনেছিলেন এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন।
আরজ আলী মাতুব্বর কাজের তুলনায় খুবই কম সম্মাননা পেয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর উপচার্য কালিদাস ভট্টাচার্য তাঁকে ডি. লিট দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজনের আগেই কালিদাস ভট্টাচার্য মারা যান। বাংলাদেশ লেখক শিবির ১৯৭৮ সালে তাঁকে ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করেন। বাংলা একাডেমি ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করেন। প্রয়াত বাংলা একাডেমির দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মানবতাকেই আমি একটা ধর্ম মনে করি। মানবতাই একটা ধর্ম। আমি এটা পালন করি এবং অন্যকে পালন করতে পরামর্শ দেই।’ তিনি ধর্মকে কেবল একটি বিশ্বাসের রূপক হিসাবে দেখেননি, তিনি যুক্তি-তর্কের সাহায্যে ধর্মকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। আদিম কাল থেকে সাধারণ মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যে জ্ঞানজিজ্ঞাসা লালন করে, তিনি সেই জ্ঞানজিজ্ঞাসা যুক্তিসঙ্গতভাবে তুলে ধরেছেন। আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ, উপমহাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদীদের উত্থানপর্বের বৈরী সময়ে আরজ আলী মাতু¦ব্বর অসাম্প্রদায়িক চেতনার নায়ক।
আরজ আলী মাতুব্বর অসীম নিষ্ঠা ও পান্ডিত্যের সাথে ৩০ বছরেরও অধিক সময়কালে এগারোটি পান্ডুলিপি রচনা করে গেছেন। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি বই এবং একটি সংকলন-সত্যের সন্ধান, অনুমান, সৃষ্টি রহস্য ও স্মরণিকা। তবে তাঁর মৃত্যুর পর ৬টি অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সীজের ফুল’ (কবিতা), ‘জীবন বানী’ (আত্মজীবনী), ‘ভিখারীর আত্মকাহিনী’(আত্মজীবনী), ‘কৃষকের ভাগ্যগ্রহ’(প্রবন্ধ) এবং ‘বেদের অবদান’(প্রবন্ধ)। আরজ আলী মাতুব্বর রচিত প্রথম বই ‘সত্যের সন্ধান’ এই পান্ডুলিপিটি লেখা শেষ হয় ১৯৫১ সালে, প্রকাশিত হয় ২৬ বছর পর ১৯৭৭ সালে।
কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে ১৯৬০ সালে ৬০ বছর বয়সে আরজ আলী মাতুব্বর তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সমান ভাগে বন্টন করে দেন। তবে একই সময়ে তিনি তার ছেলে-মেয়েদের জানিয়ে দেন, এর পর থেকে আমৃত্যু সময়ে উপার্জিত অর্থ তিনি জনকল্যাণে ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করেন। শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি অপার ¯েœহ ও ভালবাসা থেকে তিনি ‘আরজ ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে প্রতিবছর শিশুদের বৃত্তি ব্যবস্থা করেন। তিনি বিজ্ঞান চেতনায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে আবিস্কারের নেশায় তিনি জলঘড়ি ও বৈদ্যুতিক পাখা আবিস্কার করে বসলেন।
১৯৮১ সালে আরজ আলী মাতুব্বর সুস্থ শরীরে, সেচ্ছায়, সজ্ঞানে নিজের মৃতদেহটি বরিশাল মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রভুত উন্নতি সাধনের জন্য দান করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক- সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক